এ কে এম ফখরুল আলম বাপ্পী চৌধুরী :
সংবাদপত্রের লোকজন একটু বেশিই কালারফুল। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। আসুন- সংবাদপত্রের হলুদ কালারের সাথে নতুন ভাবে পরিচিত হই।
১৮৮৩ সালে আমেরিকার নিউইর্য়ক শহরে জোসেফ পুলিৎজারের সম্পাদনায় দ্য নিউইর্য়ক ওয়ার্ল্ড প্রকাশনা শুরু হয় (সেন্ট লুই পোষ্ট ডেসপ্যাচ পদ্ধতি সম্বলিত)। নতুন বইয়ের ছবি, শিশু গল্প সিরিজ, যুদ্ধের গল্প, রবিবারের বিশেষ সংখ্যা, বিভিন্ন কুইজ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কাগজটি পূরণ করা হতো।
পাঠকদেরকে আকৃষ্ট করার জন্যে অপরাধমূলক সংবাদগুলো হলুদ রঙ্গের বিভিন্ন প্রতিকৃতি/প্রচ্ছদ/ কার্টুন এর উপরে লেখা হতো।
‘হোগানের এলি’ নামক একটি কৌতুকধর্মী সিরিজে “হলুদ বাচ্চা” নামক একটি হলুদ বর্ণের চরিত্র ছিল, যা তৎকালীন সমস্ত লেখা, গল্প, উপন্যাস থেকে আলোচনার শীর্ষে থাকে এবং চরিত্রটি পুরস্কৃত হয়।
সংবাদ গুরু পুলিৎজার বিশ্বাস করতেন, সংবাদপত্র সমাজের উন্নতির জন্য সরকারী প্রতিষ্ঠান। তাই প্রকাশনাকে সমাজ সংস্কারের কাজে নিয়োজিত রেখেছেন তিনি।
নিউইর্য়ক ওয়ার্ল্ড মাত্র দুই বছরেই সমসাময়িক পত্রিকাগুলো যেমন- নিউইর্য়ক সান, টাইমস, দ্য সান, পোষ্ট, নিউইর্য়ক জার্নাল ইত্যাদি থেকে সর্বোচ্চ প্রচলিত পত্রিকা হয়ে ওঠে এবং জোসেফ পুলিৎজারের “নিউইর্য়ক ওয়ার্ল্ড” দেশের সেরা সংবাদপত্রের পুরষ্কার অর্জন করে।
যার ফলশ্রুতিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে সমসাময়িক প্রকাশকগণ ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলি নিউইর্য়ক ওয়ার্ল্ড পত্রিকার প্রকাশক-সম্পাদক, সাংবাদিকদেরকে কটূক্তি করে হোগানের এলি, হলুদ ক্রিমিয়া, হলুদ কিড্স, হলুদ প্রেস, হলুদ সাংবাদিক ইত্যাদি সমালোচনামূলক উপাধিতে আখ্যায়িত করতে থাকে। পরবর্তীতে পাঠক জনপ্রিয়তায় হলুদ প্রেস, হলুদ সাংবাদিক শব্দটি গর্বের- খ্যাতিতে পরিনত হয়েছিল।
তারপরেও পুরোনো প্রকাশকগণও জোসেফ পুলিৎজারের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে বিশ্ব বাজারে সমালোচনা অব্যাহত রাখেন। অপরাধমূলক সংবাদ স্টান্ডগুলির উপর নজরদারি শুরু করেন।
আরো গুরুতর প্রতিশোধের জন্য উপেক্ষা করে, হলুদ সাংবাদিকতার জনপ্রিয় ধারণাকে প্রভাবিত করার জন্যে ক্যালিফোর্নিয়ার খনি শিল্পপতির পুত্র উইলিয়াম র্যাডলফ হেরষ্ট নিউইয়র্ক সিটিতে আসেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বী “নিউইয়র্ক জার্নাল” পত্রিকাটি কিনে নেন। কয়েকশ কর্মচারী নিয়ে পুলিৎজারের পত্রিকা অফিস থেকে কিছু দূরে তিনি অফিস ভাড়া করেন।
পুলিৎজারের সংবেদনশীল শৈলীকে প্রতিচ্ছবি করে, পুলিৎজারের একজন কার্টুনিষ্ট শিল্পী আরএফকে অনেক টাকার বিনিময়ে ভাড়া করে, হোগানের এলির দ্বিতীয় হলুদ বাচ্চা তৈরি করার জন্য। ১৮৯০ এর উত্তেজনাপূর্ণ প্রেস ‘হলুদ বাচ্চাদের’ মধ্যে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।
বিশাল হলুদ প্রিন্টে ভিত্তিহীন শিরোনাম, মিথ্যা সাক্ষাৎকার, ছদ্মবেশী সাংবাদিক, তথ্যহীন মিথ্যা-বানোয়াট সংবাদ ছাপানো শুরু করেন। ফলশ্রুতিতে পুলিৎজারের হলুদ খ্যাতি বিতর্কে চলে আসতে থাকে। সুনাম খ্যাত হলুদ প্রেস, হলুদ সাংবাদিক শব্দটিকে বির্তকিত করে তুলে “নিউ ইয়র্ক জার্নাল”।
ইতিহাস না জেনে আজকের বিশ্বে হলুদ প্রেস, হলুদ সাংবাদিকতা, হলুদ সাংবাদিককে এক ঘৃণীত অধ্যায় বলে পরিগণিত করা হয়। যা এখন আমরা সাংবাদিক সমাজ নিরবে বহন করে যাচ্ছি।
উল্লেখ্য, প্যারিস-আমেরিকার যুদ্ধ হলুদ মিডিয়ার যুদ্ধ হিসেবে আজও পরিচিত। প্রকাশকগণ যুদ্ধের অগ্রীম ফলাফল বর্ণনা করে একাধিক ভয়ংকর যুদ্ধের গল্পও প্রকাশ করতেন।
তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো- নারী কয়েদী, মৃত্যুদন্ড, বীরযোদ্ধা বিদ্রোহী, ক্ষুধার্ত নারী, শিশুরাও যোদ্ধা ইত্যাদি। তাই তৎকালীন বিশ্বে আমেরিকার সাংবাদিক সমাজ ব্যাপক আলোচনায় এবং সমালোচনায় জড়িয়ে পড়ে হলুদ সাংবাদিকতা। এবং আমেরিকা-প্যারিস যুদ্ধকে হলুদ মিডিয়ার যুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করেন মিডিয়া বিশ্লেষক বিশিষ্টজনেরা।
হলুদ সাংবাদিকতা, হলুদ প্রেস আমেরিকার সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রের জন্যে একটি আমেরিকান পদ। ১৮৯৮ সালে আমেরিকার একটি ইংরেজী পত্রিকা উল্লেখ্য করে ‘আপ টু ডেট’ হলুদ সাংবাদিকতা আমেরিকান। আবার আমেরিকার সব সাংবাদিক হলুদ সাংবাদিক নয়। আর হলুদের মধ্যেও দুই প্রকার- প্রথমত মূল ধারার হলুদ (যা বিখ্যাত হয়েছিল), অপরটি হলো সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে নকল হলুদ (যা ইতিহাসে আজও বির্তকিত)।
“হলুদ সাংবাদিক মানেই বিখ্যাত সাংবাদিক”। “হলুদ সাংবাদিক মানেই নৈতিকতার বির্পযয়, অপপ্রচার, ধ্বংস, ধ্বস”।
১৮৯০ সালে স্যামুয়েল ওয়ারেন এবং লুই ব্র্যান্ডেইস “দ্য রাইট অফ প্রাইভেসী” শিরোনামে গবেষনায় সংবাদপত্রের সব আইন পর্যালোচনা করে অভিমত প্রকাশ করেন। নিবন্ধে সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির সাংবাদিকতার উত্তেজনাপূর্ণ ফর্মগুলির সমালোচনামূলক প্রতিক্রিয়া, যা তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তার জন্য একটি অভূতপূর্ব হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছিল। তার উপর আলোকপাত করে এই নিবন্ধটি ব্যাপকভাবে কর্মের নতুন সাধারণ আইন এবং গোপনীয়তার স্বীকৃত অধিকারের দিকে পরিচালিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। সেই থেকেই সংবাদপত্র প্রকাশের নীতিমালার উপরে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রই নজরদারি ও গুরুত্ব আরোপ করেন।
ফলে দেখা যায় বিশ্ব সাংবাদিকতায় প্রবর্তিত নীতি ও আচরণমালা এর উৎস হলো হলুদ সাংবাদিকতার প্রভাব।
আধুনিক সাংবাদিকতার অগ্রনায়ক নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড সম্পাদক জোসেফ পুলিৎজার উনবিংশ শতাব্দীতে গণমুখী সংবাদপত্রের যে ধারার সূত্রপাত করেছিলেন এবং যা আমেরিকান সমাজে বিপুলভাবে সাড়া ফেলেছিল। তা ছিল মননশীল ও সৃজনশীলতাপূর্ণ, এক আধুনিক মাত্রা। যা সংবাদপত্রকে বিপুল জনপ্রিয়তা দিয়েছিল। এবং সাংবাদিকরা সেই ধারায় সাংবাদিকতা চর্চা করে এক নতুন ধারা উপনীত করেছিল প্রথাগত সাংবাদিকতাকে।
কিন্তু সকল সমাজে সব সময়ই থাকে প্রতিযোগিতা। নিউইয়ার্ক জার্নালের নতুন ধারার এই সাংবাদিকতা সমকালীন অপরাপর সংবাদপত্রকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাড় করিয়ে দেয়। পাঠক টানতে ওই সব পত্রিকা অন্য কোন বিকল্প না পেয়ে নিউইয়র্ক জার্নাল এর কনটেন্ট অবৈধভাবে অনুসরন শুরু করে। সেই দিক থেকে নিউইয়র্ক জার্নাল ও জোসেফ পুলিৎজার নতুন ধারার সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হলেও উইলিয়াম রুডলক হেরেষ্ট এর সম্পাদিত নিউইয়র্ক জার্নাল এর কাউন্টার জার্নালিজম হলুদ সাংবাদিকতাকে জমিয়ে দেয়।
সমকালীন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য সংবাদপত্র অবশ্য সৃজনশীল এই ধারা চর্চ্চায় শামিল হতে না পারায় তারা সনাতনী ধারাতেই থাকেন।
হলুদ সাংবাদিকতা পাঠকপ্রিয়তা পেলেও নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড ও নিউইয়র্ক জার্নাল একে অপরকে টেক্কা দিতে এক পর্যায়ে যে কৃত্রিম ও অনৈতিক পথ বেছে নেয় তা চরমদ্বন্দ্বে রূপ নেয়। এক পর্যায়ে এক পত্রিকা আরেক পত্রিকার সাংবাদিকের সাথেও ইথিক্যাল সংঘাতে জড়িয়ে পরে।
সেনসেশনাল জার্নালিজম খবর কেন্দ্রিক সাংবাদিকতাকে নিছক চাঞ্চল্যকর উপাদানে ভরপুর করে ¯্রফে পাঠকের মনে সুড়সুড়ি দিতে এক পর্যায়ে কাল্পনিক খবর, চমক তৈরি জন্য ভিত্তিহীন, গালগল্পময় খবর, কোন ঘটনাকে অযৌক্তিকভাবে ফলাও করে প্রচার স্পর্শকাতর উত্তেজনা ও আবেগ সৃষ্টির উদ্দেশ্য পূরণ এবং এই ঘরনায় তথ্য সংগ্রহের সাংবাদিকতার কোড অব কন্ডাক্টকে গুরুত্ব না দেওয়া ইত্যাদি কিছু কারনে ইয়োলো সাংবাদিকতা নেতিবাচক ভাবমূর্তি পায়।
কিন্তু শুরুতে পুলিৎজার প্রবর্তিত হলুদ সাংবাদিকতা জননন্দিত ও প্রভাবশালী সাংবাদিকতার মানদন্ডে ছিল উত্তীর্ণ। যা আমেরিকান সরকারকে পর্যন্ত প্রভাবিত করেছিল। সমাদৃত হয়েছিল হলুদ সাংবাদিকতার কার্যকারন।
বিশ্ব সাংবাদিকতায় নোবেল প্রাইজ এর মতো মর্যাদাসম্পন্ন পুরষ্কারটি প্রবর্তিত রয়েছে হলুদ সাংবাদিকতার জনক জোসেফ পুলিৎজারের নামে।
মেধা, মনন, বুদ্ধিবৃত্তিক, সৃজনশীলতা ও পাঠকের প্রতি দায়বদ্ধতা হলুদ সাংবাদিকতার অঙ্গিকার ও বৈশিষ্ট্য। সকল সাংবাদিকের পক্ষে সেকালে সেটি চর্চা করা সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে, প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অপসাংবাদিকতা হলুদ সাংবাদিকতার উপর ভর করায় পরবর্তিতে এনিয়ে বিভ্রম সৃষ্টি হয়। তার অর্থ এই নয় মূল হলুদ সাংবাদিকতা এর কোন নেতিবাচক অর্থ আছে। তৎকালে মার্কিন জনগণ, পাঠক, সরকার যা লুফে নিয়েছিল তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ঐতিহাসিকভাবে মহান। যেকালে অনেকে হলুদ সাংবাদিক হতে না পেরে বলছিল, “নাচতে না জানলে, চলন বাঁকা।”
সেই সময়ে হলুদ সাংবাদিকতা হতে না পারার ব্যর্থতার গ্লানিতে কষ্ট পাওয়ারা যে সমালোচনা শুরু করেছিল। তা আজও প্রতিধ্বনিত হয় ইতিহাস না জানার ইতিহাস জানা-অজানায়।
আজকে হলুদ সাংবাদিকতার বলতেই যা বুঝায়, হলুদ সাংবাদিক বলতে যা বুঝায় সেটি ব্যতিক্রম, অপসাংবাদিকতা। যা সমর্থন যোগ্য নয়।
তাই বলে ঐতিহাসিক হলুদ সাংবাদিকতার বিকাশ, চর্চা, অনবদ্ধ ইতিহাস জানা একজন সাংবাদিকের জন্য অপরিহার্য। যা সাংবাদিকতার জন্য ঐতিহাসিক অর্জন। যা বির্বতনের মধ্যে দিয়ে ভিন্ন অর্থ তৈরি করেছে।
প্রকৃত পক্ষে, ইতিহাস বলে হলুদ সাংবাদিক হওয়া সহজ নয়।
“হলুদ সাংবাদিক হওয়া শুধু মুশকিল নয়, নামুন্তকিন !
Leave a Reply